লাবনী, পোশাক কারখানার একজন অপারেটর। বেতন ওভারটাইমসহ পান ১১ হাজার টাকার কাছাকাছি। পোশাক শ্রমিকদের জন্য বানানো এক ছাউনির নিচে একটি ঘরে স্বামী-সন্তানসহ থাকেন। ৩ হাজার টাকা ভাড়া । ২০০ টাকা করে বাড়বে ভাড়ার শর্ত, জানুয়ারি আর জুনে । হেপাটাইটিস-সি আক্রান্ত লাবনীর স্বামী,৪ হাজার টাকার ওষুধ লাগে মাসে । বাকি মাসের হিসাব দেওয়ার আগে লাবনী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন: ‘আমার জন্য ৩০ টাকা না, আপনার জন্য যে লাউ ৬০ টাকা। কীভাবে চলি শুনতে চান?’
শুধু লাবনী নন, লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক প্রতিমাসের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন লাবনীর মতো। লাবনী বলেন, ‘বাসায় ফিরে এসে রান্না চড়িয়ে কাপড় সেলাই করতে বসি। ভোররাত পর্যন্ত কাপড় সেলাই করি। ছেলের বয়স ৭ বছর হলেও স্কুলে দিতে পারিনি । কে তাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করবে? কে দেবে টাকার জোগানই?’ সরকারি স্কুলে বাড়ির আশপাশে না থাকায় বিনা বেতনে পড়া যায় না, হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি পোশাক শ্রমিকের সন্তান শ্রমিকই হবে বলে।
বাঁধা মুদির দোকান সবার আছে
পোশাক শ্রমিকদের বেশিরভাগ পরিবার বাঁধা মুদির দোকানের ওপরে চলে । সেই ধারাবাহিক ঋণ এ মাসের টাকা ও মাসে শোধ করে চলে । ‘আমার ঘরভাড়া আর বাচ্চার খরচেই সবটা চলে যায়, হেলপার মিজান বলেন, খাবো কী এরপর? মাসিক লেনদেন চলে পাড়ার মুদির দোকানে । সর্বোচ্চ ভালো খাওয়া হলো ডিম । ব্রয়লার মুরগি বলতে মাংস । হাত দেওয়া যায় না মাছ-মাংসে ,সবজিতে হাত দেওয়া যায় না। সবজি বিক্রি হয় দিনশেষে কম দামে, কিনে সেগুলো বেছে খাওয়া হয়।’
‘আমরা ৩ ভাইবোন একসঙ্গে থাকি আরেক হেলপার ময়না বলেন, একজন গাড়ির ড্রাইভার, ৩ জনের দুজন গার্মেন্টসে কাজ করি। ভালোমতোই চলে ৩ জনের আয়ে সংসার ।’ আয়ে কোনও জীবন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি গার্মেন্টসের একজনের ।
মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভ
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রমিকদের সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার টাকা এরমধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ টাকা, খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা৷
প্রায় অসম্ভব বলে জানাচ্ছেন শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা এই টাকায় পরিবার নিয়ে টিকে থাকা ,তারা বলছেন, জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের থাকা-খাওয়া, সন্তান লালনপালনের ন্যূনতম সুবিধা ছাড়াই ।
শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে না শ্রমিক নেতারা আরও বলছেন, ক্রেতা, মালিক ও সরকারের ত্রিমুখী সদিচ্ছা ছাড়া পোশাক । বাজেট মানেই তো মূল্যবৃদ্ধি । শ্রমিকদের জন্য বাজেটে কিছু নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা, প্রণোদনা দেওয়া হলেও মালিকদের ।
বরাবরই ঘাটতি বাজেট
বরাবরই তার চেয়ে ৫ থেকে ৩ হাজার টাকার ঘাটতি থাকে। শ্রমিকের জন্য যে বেতন চাওয়া হয় গত ৩০ বছর ধরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বাইরে রফতানিতে আয়ই প্রধান পোশাক শ্রমিকদের শ্রমে তৈরি পোশাক। মজুরি অন্য সব খাতের চেয়ে কম অথচ এই খাতের শ্রমিকদের।
কিন্তু তখন ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা করার দাবি ছিল ১৯৯৪ সালের ঘোষিত মজুরি ৯৩০ টাকা ২০০৬ সালে বেড়ে হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। ২০১০ সালে মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ৩ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে গঠিত মজুরি বোর্ড মজুরি নির্ধারণ করে ৫ হাজার ৩০০ টাকা। ১১টি গ্রেড করা হয় ২০১৮ সালে তাদের বেতনের । এরমধ্যে ৭টি ও কর্মচারীদের জন্য নির্ধারণ করা হয় ৪টি শ্রমিকদের জন্য । নির্ধারণ করা হয় ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার । ১৬ হাজার টাকা করার দাবি ছিল যদিও জীবনযাপনের ব্যয় হিসাব করে ন্যূনতম ।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বরাবরই ঘাটতি বাজেটে যায় শ্রমিকদের জীবন । যেটুকু ন্যূনতম দরকার তারচেয়ে ৫ থেকে ৩ হাজার টাকা কমিয়ে তাদের মজুরি নির্ধারিত হয়। ফলে বাড়বে কীভাবে তাদের জীবনমান? তারা বরং বাধ্য হচ্ছেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ থাকতে ।’
যে পরিমাণ রফতানি আয় আসে শ্রমিকদের কল্যাণে সে তুলনায় তাদের বেতন বাড়ানোয় অনীহা কেন—জানতে চাইলে সভাপতি বলেন গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের, শ্রমিকের স্বর আমাদের মাধ্যমে তত দ্রুত পৌঁছায় না, ‘মালিক বিজিএমইএ-এর সহায়তায় যত সহজে সরকারের কাছে পৌঁছায়, ব্যর্থতা আমাদের ।’ তিনি বলেন, ‘আশি-নব্বই দশকে গার্মেন্টস-এর লাভের যে অঙ্ক মালিকপক্ষ, সেটি ভুলতে পারেন না। তারা মনে করেন, ঠিক সেই পরিমাণ লাভই সবসময় থাকবে। কিন্তু গার্মেন্টসের কমপ্লায়েন্স—সব মিলিয়ে এখন সেই অবস্থা নেই।’ ক্রেতাদের চাহিদা, যদি শ্রমিকের জন্য ভাবা হতো তাহলে সুদিন ফিরতে সময় লাগতো না বলে দাবি করেন তিনি, এরপরও যে লাভ হয় সেটির একটি অংশও দিত।
#garmentsworker #garmentslife #mizanweb #mizanurrahman #workergarments #lifegarments #webmizan #mizanwebsite
Comments